যারা অখণ্ড পাকিস্তানের চেতনার কফিনে সর্বশেষ পেরেক পুঁতে দিয়ে পঁচিশে মার্চের ভয়াল রাতের ঘটনা ঘটায় এবং সেই নিষ্ঠুরতা পুরো নয় মাস বজায় রাখে, একটি গণতান্ত্রিক অর্জনের ফলকে নস্যাৎ করে দিয়ে দেশের এক অংশে নির্বিচারে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, নিপীড়ন হওয়া সত্ত্বেও কেন পাকিস্তানের অপরাংশের জনসমাজের প্রায় সকল স্তরে নির্লিপ্ততা দেখায় বা এজন্য বাঙালীদের আগাগোড়া দোষারোপ করে, কী প্রেক্ষাপটে, কেন এমনটি করেছিল, একাত্তরের ঘটনাবলীকে তারা তখন কীভাবে মূল্যায়ন করেছিল বা এখনো করে-সে ব্যাপারে খুব সামান্য কথাবার্তাই আমরা এ পর্যন্ত শুনেছি। পাকিস্তানীদের কাছ থেকেও এসব বিষয়ে কোন খোলামেলা বক্তব্য বা মূল্যায়নও আশা করা যায় না, কারণ বিষয়টি পাকিস্তানের সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ড ও তার পরাজয়কে ঘিরে আবর্তিত এবং পাকিস্তানী সমাজজীবন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্পষ্টভাবে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার মত স্বাধীনতা ভোগ করে না। এই প্রেক্ষাপটে উপরোক্ত বিষয়ে যতটা সম্ভব তথ্য আহরণের লক্ষ্যে সাক্ষাৎকার গ্রহণের ভিত্তিতে এই বইটি প্রণীত হয়েছে। যাঁরা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন সামরিক-বেসামরিক ১১ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আমলা, ৯ জন রাজনীতিবিদ ও বাকী ৮ জন সিভিল সমাজের প্রতিনিধি। সাক্ষাৎকারদানকারীদের অধিকাংশ প্রত্যক্ষভাবে পূর্ব পাকিস্তান বিষয়ে নীতি নির্ধারণে ও একাত্তরের যুদ্ধে জড়িত ছিলেন। যাঁরা জড়িত ছিলেন না তাঁরাও পাকিস্তান সমাজের সচেতন অংশের প্রতিনিধি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সামগ্রিকভাবে পাকিস্তানের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল তা বুঝতে গেলে বা এ বিষয়ে কিছু রচনা করতে গেলে সংকলিত এই সাক্ষাৎকারগুলি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
মহিউদ্দিন আহমেদ (জ. ১৯৪৪) সংবাদপত্রে সাংবাদিকতার মাধ্যমে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেন। তিনি প্রায় ৪ বছর লাহোরের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। পরে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের পাকিস্তান শাখায় সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। এ সময় তাঁর প্রকাশনার নানাবিধ বিষয়ে ব্যাপক পেশাগত প্রশিক্ষণ লাভের সুযোগ হয়। তিনি স্বাধীনতার পর অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, বাংলাদেশ-এর প্রধান নির্বাহী নিযুক্ত হন। তিনি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড-এর প্রতিষ্ঠা থেকে এ পর্যন্ত তার প্রকাশক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকরূপে কর্মরত আছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই। তিনি দেশে ও বিদেশে পুস্তক প্রকাশনা বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি করে আসছেন। দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় উন্নয়ন বিষয়েও তাঁর রচিত নিবন্ধ প্রায়শ প্রকাশিত হয়। পুস্তক প্রকাশনায় বিরল অবদান রাখার জন্য তিনি ১৯৯১ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র স্বর্ণপদকে ভূষিত হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ও গবেষক মুনতাসীর মামুন, পিএইচ.ডি. (জ. ১৯৫১) লেখালেখির জগতে সুপরিচিত তাঁর বিশ্লেষণাত্মক অথচ প্রাঞ্জল রচনার জন্য। সমাজ-গবেষণার যখন যে বিষয়টি তিনি সম্পাদন করেছেন, তাই পেয়েছে পৃথক ও ব্যতিক্রমী মাত্রা। যে-কোনো নিরস বিষয় তাঁর লেখার জন্য হয়ে ওঠে বাঙ্গময়। একক ও যৌথভাবে প্রবন্ধ-গবেষণা বিষয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা অধিক। সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও আছে পঞ্চাশের অধিক গ্রন্থ। সংবাদপত্রে সাহসী কলাম লেখক হিসাবেও তাঁর খ্যাতি সমাধিক। লেখক বাংলা একাডেমি পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন (১৯৯২)।