১৯৬৯ সালের পূর্ব বাঙলা। কী এক জীবনস্পর্শী মন্ত্রের মুখে বিস্ফারিত চারদিক। কেঁপে ওঠে নগর ঢাকা। কাঁপে শহর, বন্দর, গল্প, নিভৃত গ্রাম, এমনকি যমুনার দুর্গম চর এলাকা। কখনো কঠিন বুলেটের আঘাতে, কখনো ভেঙ্গে দেওয়া আঁধির ঝাপটায়। মিটিং আর মিছিল আর গুলিবর্ষণ আর কারফ্যু-ভাঙা আর গণআদালত – সব জায়গায় ফেটে পড়ে ক্ষোভ ও বিদ্রোহ। সব মানুষেরই হৃদয়ের অভিষেক ঘটে একটি অবিচল লক্ষ্যে—মুক্তি।
মুক্তি? তার আসার পথও যে একরকম নয়। কারো স্লোগান,'দিকে দিকে আগুন জ্বালো', কারো ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা'। কেউ দাঁড়ায় এই সারিতে, কেউ ঐ সারিতে দাঁড়িয়ে খোলা আকাশের দিকে দৃষ্টি রাখে। মুক্তির স্বাদ কি এমনই!
উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হয় ঢাকা। সেই ঢাকার ঘিঞ্জি গলির মধ্যে একটি বাড়ি। সেই বাড়িতে থাকে একজন, নাম যার ওসমান গনি ওরফে রঞ্জু। যে সব শোনে, দ্যাখে, মিটিঙে যায়, মিছিলেও যায়। তবু কিছুতেই সে যেন শরিক নয়। তাকে ঘিরে রাখে তার চিলেকোঠার চার দেওয়াল। ওই দেওয়াল বিচ্ছিন্নতার ও আত্মপ্রেমের। তার প্রতিবেশী তারই সহনামী আরেক রঞ্জু, এক কিশোর। তার তরুণী বোনের প্রতি ওসমান আসক্ত, মেয়েটির শরীর সে কামনা করে। কিন্তু প্রেম তার কিশোর রঞ্জুর প্রতি। এই প্রেমের খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ওসমানের ডানা তিরতির করে, কিন্তু অত সহজ কি বেরুনো?
গণঅভ্যুত্থানে সন্ত্রস্ত শাসকদের নতুন করে আরোপ করা সামরিক শাসনের নির্যাতন শুরু হলে বন্ধুরা যখন বিহ্বল, ওসমানের ডানায় তখন লাগে প্রবল বেগ। সহনামী কিশোরকে সে চুম্বনে রক্তাক্ত করে, বিকৃত যৌনতার বশে নয়, আত্মপ্রেমে পরাজিত হয়ে। ওসমান 'একজন'। সে এক নার্সিসাস। কিন্তু এখানে তার শেষ নয়। নিজের খাঁচা থেকে বেরুবার জন্য তার ডানা ঝাপটানো পরিণত হয় প্রচণ্ড ক্রোধে। রঞ্জুকে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেওয়ার জন্য সে প্রাণান্ত উদ্যোগ নেয়। এ কি তার আত্মপ্রেম বিসর্জনের প্রস্তুতি?
পরিচিত সবাই ওসমানকে চিহ্নিত করে বদ্ধ পাগল হিসেবে। অনুরাগী বন্ধুরা তাকে বন্দী করে রাখে নিজের ঘরে।
এখন এই বিচ্ছিন্ন ঘর থেকে ওসমানকে উদ্ধার করতে পারে কে? এক নেতায় বিশ্বাসী আলাউদ্দিন? ভোটের রাইট-প্রার্থী আলতাফ? রাজনীতি-বিশ্লেষক বামপন্থী আনোয়ার?—না এরা কেউ নয়। চিলেকোঠার দুর্গ থেকে ওসমানকে বেরিয়ে পড়তে প্ররোচনা দেয় হাড্ডি খিজির যে নিজের বাপের নাম জানে না, যে বড় হয়েছে রাস্তায় রাস্তায়, যার মা-বৌ দুজনেই মহাজনের ভোগ্য এবং গণঅভ্যুত্থানের সদস্য হওয়ার অপরাধে মধ্যরাতে কারফ্যু-চাপা রাস্তায় যে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয় মিলিটারির হাতে। নিহত খিজিরের আমন্ত্রণে ও আহ্বানে সক্রিয় সাড়া দিয়ে ওসমান ঘরের তালা ভাঙে। সবার অগোচরে সে বেরিয়ে আসে রাস্তায়, কারফ্যুর দাপট অগ্রাহ্য করে। তার সামনে এখন অজস্র পথ। পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ—সব দিক তার খোলা। ওসমান যেদিকেই পা বাড়ায় সেদিকেই পূর্ব বাঙলা।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস । জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে বি.এ. অনার্স (১৯৬৩) ও এম.এ. (১৯৬৪) ডিগ্রি লাভ করেন। অধ্যাপনা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। সমাজ, ঐতিহ্য ও ইতিহাস-সচেতন এই লেখক অনাহার, অভাব, দারিদ্র ও শোষণের শিকার হয়ে যারা মানবেতর জীবনযাপন করে, সে-সকল অবহেলিত মানুষের বাস্তব জীবন-চিত্র নিঁখুতভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর গল্প ও উপন্যাসে। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ঘাতকব্যাধি ক্যান্সারে ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি তিনি মারা যান। ইউপিএল থেকে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ: অন্য ঘরে অন্য স্বর, চিলেকোঠার সেপাই, খোঁয়ারি।