Filters

১৮৬৮ সালের ১৮ মার্চ ভলগার তীরবর্তী নিজনি নগরভোদ গ্রামে ম্যাক্সিম ও ভারভারা দম্পত্তির কোলজুড়ে এলো তাদের প্রথম সন্তান; নাম আলেক্সেই ম্যাক্সিমোভিচ পেশকভ। আলেক্সেইয়ের জন্মের বছর চারেকের মাথায় ১৮৭১ সালের গ্রীষ্মে বাবা ম্যাক্সিম ওলাওঠা রোগে মারা যান। সন্তান-সন্ততি নিয়ে মা ভারভারার আশ্রয় হয় তাঁর বাবা ভাসিলি কাশিরিনের সংসারে। তবে একটুও সুখের দেখা মেলেনি বিত্তবান নানার সংসারে। নানা নাতিকে দুই চোখে দেখতে পারতেন না। কারণে অকারণে মারধর করতেন। কিন্তু তাঁর দরদী নানী আকুলিনার দুই নয়নের মণি ছিলেন আলেক্সেই। নাতিকে প্রায়শই শোনাতেন ছড়া, কিংবদন্তি আর রূপকথার নানা গল্প। আলেক্সেইও খুব আগ্রহ নিয়ে তা শুনতেন। বস্তুত, অখ্যাত কিশোর আলেক্সেই থেকে সাহিত্য চর্চা করে বিপ্লবের ঝড় তোলা ম্যাক্সিম গোর্কি হয়ে ওঠার ভ্রূণ জন্মায় ছেলেবেলায় নানীর হাতে। দুর্ভাগা আলেক্সেই মাকেও হারিয়ে ফেলেন ১৮৭৯ সালে। পেট পুরে দুবেলা দু'মুঠো খাবার জুটত না; পান নি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটুকুও। হাতে গোনা যে কয়দিন একটি স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন তা ছিল অনেকটা না যাওয়ার মতোই। আর বাড়িতে পড়াশোনার পরিবেশ না থাকায় হয়ে উঠেছিলেন ডানপিটে ভবঘুরে এক কিশোর। মায়ের মৃত্যুর পর নানা আর দ্বায়িত্ব নিতে চান না এবং আলেক্সেইকে সাফ জানিয়ে দেন, নিজের রাস্তা দেখে নিতে। পেটের দায় আশ্রয়হীন ১২ বছরের কিশোরকে এক অজানা পথে নামায়। প্রথম কিছুদিন পেট চালান নানা জনের টুকটাক ফরমাস খেটে। এর কিছুদিন পর কাজ জুটে যায় একটি খাবার হোটেলে। পরবর্তীতে একে একে যুক্ত হন বিচিত্র সব পেশায়- মুচির দোকান থেকে শুরু করে রেলস্টেশনের দারোয়ান, রাস্তার দিনমজুরি থেকে শুরু করে বাগানের মালির কাজ পর্যন্ত সকল কাজই করতে হয়েছে তাঁকে। বিক্ষুব্ধ জীবন, হাড়ভাঙ্গা-খাটুনি আর জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে একের পর এক পেশা পরিবর্তন করে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন পথে পথে ঘুরে। বাড়িছাড়া হয়ে একবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন তিনি। এরপর দীর্ঘ পাঁচ বছর পায়ে হেঁটে সমগ্র রাশিয়া ভ্রমণ করেন তিনি। এভাবেই কৈশোর পেরিয়ে দারিদ্র্যকে নিত্যসঙ্গী করে যৌবনে পদার্পণ করেন আলেক্সেই। কপালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না জুটলে কি হবে হাড়-খাটুনির কৈশোরে কাজের ফাঁকে ফাঁকে আলেক্সেই প্রায়ই মনোযোগী হতেন বই নিয়ে। শত কষ্টের মাঝেও একটু শান্তির পরশ খুঁজে পেতেন বইয়ের পাতায় পাতায়। তাঁর কাছে বইয়ের কোনো বাছবিচার ছিল না। একে একে অর্থনীতি, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজনীতি, দর্শনসহ আরও অনেক কিছু। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন অপ্রাতিষ্ঠানিক স্বশিক্ষিত। আলেক্সেইয়ের কৈশোরের শেষ ভাগ এবং যৌবনের প্রথমভাগ কেটেছে কাজান শহরের আলো বাতাসে। তাঁর মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছিল কাজানের এক জরাজীর্ণ বাগানবাড়িতে। সেখানে থাকাকালীন তাঁর পরিচয় হয় পেখনেভ নামের এক বিপ্লবী ছেলের সঙ্গে। সেকালে রাশিয়ায় চলছিল জারের রাজত্বকাল। আর দেশজুড়ে চলছিল শাসনের নামে রীতিমতো শোষণ আর অত্যাচার। দেশের এমন পরিস্থিতিতে পেখনেভনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আলেক্সেই জড়িয়ে পড়েন 'আত্মবিকাশ' নামে একটি বামপন্থী বিপ্লবী দলের সাথে। বিপ্লবী দলের সাথে যুক্ত হয়ে পরিচিত হন কার্ল মার্কসের রচনাবলীর সাথে। স্বল্প সময়ে তাঁর চিন্তাধারায় আসে আমূল পরিবর্তন। দলের প্রতি তাঁর মূল কাজ ছিল দুটি; জ্ঞানদান আর দলীয় প্রচার। এককালের বখে যাওয়া কিশোর 'আলেক্সেই' পরিণত বয়সে এসে হয়ে ওঠেন 'ম্যাক্সিম গোর্কি'। এই নামের পিছনেও এক টুকরো ইতিহাস রয়েছে। রুটি কারখানায় জর্জিয়ার তিতলিসে বামপন্থী আরেক শ্রমিক আলেক্সান্দর কালিজনির সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। কালিজনি তাঁর জীবনের দুঃখ-দুদর্শার কাহিনী শুনে সেগুলো লিপিবদ্ধ করার পরামর্শ দেন। এরপর শ্রমিক সমর্থিত 'ককেশাস' নামক একটি পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প 'মাকার চুদ্রা' ছাপা হয়। আর এখানেই বদলে যায় তাঁর আদি নাম। গল্পের লেখকের নামের জায়গায় আলেক্সেই ম্যাক্সিমভিচ পেশকভ তাঁর নাম পরিবর্তন করে রাখেন 'ম্যাক্সিম গোর্কি'। জীবনে দুঃখ আর সংগ্রামের কষ্টিপাথরে ঘষে নাম বদলেছিলেন ম্যাক্সিম গোর্কি। বাংলায় গোর্কি শব্দের অর্থ 'তিক্ত'। যার অর্থ দাঁড়ায় তিক্ততায় ভরা জীবন। ম্যাক্সিম গোর্কির জীবন সংগ্রামের আখ্যান তাঁর নামের মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। প্রতিবাদী লেখার কারণে বহুবার জার শাষকদের রোষানলে পরে কারাবরণ করতে হয় তাঁকে। অঘোষিত গৃহবন্দী অবস্থায় ম্যাক্সিম গোর্কি ১৯৩৬ সালের ১৮ জুন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ম্যাক্সিম গোর্কির অমর উপন্যাস 'মা'- এখন অব্দি বিভিন্ন ভাষায় প্রায় তিন শতাধিক সংস্করণ বেরিয়েছে। প্রায় সব ভাষাতেই উপন্যাসটির অনুবাদ গ্রন্থ বেরিয়েছে। আমার ছেলেবেলা তাঁর জীবন ভিত্তিক উপন্যাস। আমার ছেলেবেলা ছাড়াও পৃথিবীর পথে, পৃথিবীর পাঠশালায়, গ্রীষ্ম, ত্রয়ী, স্কেচস অ্যান্ড স্টোরিস (তিন খণ্ড), টুয়েন্টি সিক্স মেন অ্যান্ড এ গার্ল, ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ও মাই ইউনিভার্সিটিজ তাঁর অন্যতম রচনা। জীবনের শেষ সময়ে তিনি লিখেছেন 'ক্লিম সামগিনের জীবন'।


Books by the Author